ভাঙ্গার জনপদের ফের আতঙ্ক সাবেক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা সুমন
-
সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেলেও ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছেন
-
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা মামলাসহ একাধিক মামলার আসামী
-
পুলিশ বলছে, খোঁজা হচ্ছে সুমনকে
ফরিদপুর প্রতিনিধি :
গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেলেও ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছেন ফরিদপুরের ভাঙ্গার জনপদের আতঙ্ক হিসেবে পরিচিত মোখলেসুর রহমান সুমন (৩৬)। পুনরায় তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন নিজ এলাকার ব্যবসায়ী থেকে সাধারন মানুষ। তাঁর অত্যাচারে নিরবে নিভৃতে কাঁদছেন অনেকে, ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না কেউ।
মোখলেসুর রহমান সুমন ভাঙ্গা উপজেলার আজিমনগর ইউনিয়নের তাড়াইল গ্রামের হাজী ইরফান উদ্দিনের ছেলে। এছাড়া সে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি এবং বর্তমানে কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের উপ-কমিটির সম্পাদক পদে রয়েছেন। তাঁর বড় ভাই মোতালেব মাতুব্বর ওই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে রয়েছেন।
তিনি ২০২৩ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ঘোড়া প্রতীকে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে পরাজিত হোন। এই সুমনের নামে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার ঘটনায় একটি মামলার ১০১ নম্বর আসামী। এছাড়া অস্ত্র, ডাকাতি, চাঁদাবাজি সহ থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে পুলিশ সুত্রে জানা গেছে।
উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে হেরে গিয়ে ওই বছরের ৫ মে প্রতিপক্ষ ঈশ্বরদী গ্রামের ইমরান তালুকদার (৩২) ও শাওন বেপরী (২০) নামে দুই যুবককে ধরে নিয়ে মালিকানাধীন ওই ফিলিং স্টেশনে নিয়ে পায়ের রগ কেটে দেন। এ ঘটনার মামলার প্রধান আসামীও তিনি।
জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফরউল্যাহর ক্ষমতার বলয়ে নিজ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন এই সুমন। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জোড়পূর্বক জমি দখল তাঁর নেশায় পরিণত হয়। এই সময়ে তিনি ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে একটি ফিলিং স্টেশন ও দুটি ইটভাটা গড়ে তোলেন। এই ফিলিং স্টেশনের দোতলা ভবনে বসে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা করতেন তিনি।
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট সরকার পতনের পর ভাই মোতালেব মাতুব্বরসহ আত্মগোপনে চলে যান। তবে সম্প্রতি এলাকায় ফিরে প্রকাশ্যে এসেছেন তিনি। অসহায় ব্যক্তিদের মারধর, হুমকি-ধমকি সহ জোর জবরদস্তি করে জায়গা দখল তাঁর নিয়মিত কর্মকান্ড হয়ে উঠেছে। সম্প্রতি তাঁর বাহিনীকে নিয়ে দেশীয় ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়াও দিয়েছেন। বর্তমানে তাঁর ভয়ে তটস্থ হয়ে উঠেছেন ওই এলাকার জনপদ।
গত ১৩ই এপ্রিল নয়ন হাওলাদার নামে এক ব্যক্তির এক কোটি টাকার সমমূল্যের জমি ৯ লাখ টাকায় নেয়ার জন্য নাটকীয় কান্ড ঘটান। জিম্মি করে পদ্মার চরে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। তবে স্থানীয়দের বাঁধার মুখে ওই জমি লিখে নিতে পিছু হটেন তিনি। তাড়াইল গ্রামের গফুর হাওলাদারের দুই মেয়ে রাশিদা বেগম ও হাসি বেগম, ঈশ্বরদী গ্রামের বেলায়েত হাওলাদারের নিকট থেকে জোড়পূর্বক জমি ক্রয় করে টাকা দিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা।
এই সুমনের তাড়াইল ইউনিয়নে দুটি ইটভাটা রয়েছে। সম্প্রতি স্থানীয় কামরুল মোল্যা নামে ইট-বালু ব্যবসায়ী তাঁর নিকট থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা ইট ক্রয়ের চুক্তি করেন এবং চুক্তি অনুযায়ী টাকা তুলে দেন তাঁর হাতে। তবে কিছু ইট দেয়ার পরে আর দিচ্ছেন না বলে এই ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন। কামরুল মোল্যা আজকের পত্রিকাকে বলেন, আমি ইটের ব্যবসা করি। বিভিন্ন সময় তাঁর ভাটা থেকে ইট নেয়া হয়। আমার নিকট থেকে ইট দেয়ার নামে পঞ্চাশ লাখ নিয়ে নেন কিন্তু কিছু ইট দেয়ার পরে এখনও কোনো ইট দিচ্ছেন না, এমনকি টাকাও ফেরত দিচ্ছেন না। ইট চাইলে বিভিন্ন তালবাহানা করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানান, থানায় একাধিক মামলা এবং আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সহযোগী হিসেবে তাঁর জোড়ালো ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও আইন-শৃঙ্খলাবাহীনির ধরাছোয়ার বাইরে রয়েছেন। আওয়ামী লীগের ক্ষমতাবলে এলাকার মানুষকে জিম্মি করে রাম রাজত্ব পরিচালনা করেছেন তিনি। তার ভয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর আজিমনগর ইউনিয়ন সহ ভাঙ্গায় কেউ মুখ খুলতে পারত না। কাজী জাফরউল্ল্যাহর ঘনিষ্ট সহচর হওয়ায় আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সরাকে ধরাজ্ঞান মনে করতেন । এ সময় ভাঙ্গার প্রায় অর্ধশত মানুষের জমি দখল করে নিয়েছেন।
তারা ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই সুমন আবারও এলাকায় ফিরে এসে ফের পুরনো কর্মকান্ডে মেতে উঠেছেন। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনুস যখন দেশকে সংস্কার করে সুন্দররুপে সাজাতে ব্যস্ত ঠিক তখনই দক্ষিণবঙ্গের প্রবেশদ্বার ভাঙ্গা উপজেলার জনগণ ও জনপদ এই সুমনের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। বর্তমানে তাঁর খালাতো ভাই পাশ্ববর্তী শিবচর উপজেলার সাবেক চিফ হুইপ লিটন চৌধুরীর ঘনিষ্ট সহচর ফরহাদ চৌধুরীকে সাথে নিয়ে মালিকানাধীন ইটভাটায় বসেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করছেন। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী তাকে গ্রেপ্তারও করছেন না। অনিতবিলম্বে তাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে মোখলেসুর রহমান সুমনের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেয়া হলেও তা বন্ধ পাওয়ায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
বিষয়টি নিয়ে চলতি মাসের উপজেলা প্রশাসনের আইনশৃঙ্খলা সভায় আলোচিত হয়ে ওঠে। সুমনের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার দাবি জানান অনেকে। এ সময় প্রশাসন তাকে গ্রেপ্তারের আশ্বাস দেন।
ভাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আশফাক হোসেন বলেন, সুমনের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। বর্তমানে সে পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।