সালথায় পেঁয়াজ সংরক্ষণের ঘর বরাদ্দে টাকা গ্রহন ও নির্মাণে অনিয়ম, বিপাকে কৃষক
দেশজুড়ে পেঁয়াজ উৎপাদনের দিক থেকে অন্যতম ফরিদপুরের সালথা উপজেলা। কিন্তু পেঁয়াজ সংরক্ষণে মডেল ঘরের কাজ শেষ না হওয়ায় বিপাকে পড়েছে সালথার কৃষকরা। বরাদ্দকৃত ঘর বন্টনেও হয়েছে অনিয়ম ।
কৃষকরা জানায়, এ বছর কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ পদ্ধতি আধুনিকায়ন এবং বিপণন কার্যক্রম উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে সালথায় ৪৫টি ঘরের বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু সালথা উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষকদের নাম পাঠালেও কোনো কৃষক বিনামূল্যে ঘর পাননি।
তাদের অভিযোগ, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা শাহজাহান আলী ও আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হেলাল উদ্দিনের যোগসাজশে ১০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার বিনিময়ে এসব ঘর দেওয়া হয়েছে খবর পাওয়া গেছে । এমনকি ঘরের ডিজাইনও বিকৃত করে নির্মাণ করা হয়েছে।
জানা যায়, পাঁচ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা এসব ঘর। মাত্র এক শতাংশ জমিতে টিন-বাঁশ, লোহা ও কংক্রিটের সমন্বয়ে তৈরি করা হয়। এতে প্রতিটি ঘরে বাতাস চলাচলের জন্য ৬টি বায়ু নিষ্কাশন পাখা সংযুক্ত করা হয়েছে। মূলত ভ্যান্টিলেশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকার কারণেই সংরক্ষিত পেঁয়াজ নষ্ট হবে না। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা পরিমাপের জন্য প্রতিটি ঘরে হাইগ্রোমিটার রয়েছে। এসব ঘরে সংরক্ষণ করা যাবে সাড়ে ৩শ থেকে ৪শ মণ পেঁয়াজ।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বর মাসে ফরিদপুরের মেসার্স জাকির এন্ড ব্রাদার্স ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৭% লেস দিয়ে এসব ঘরের কাজ শুরু করেন। চলতি বছরের ৩০ মার্চ ঘরের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ঠিকাদার ও দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের উদাসীনতায় এখনও কাজ শেষ হয়নি। অধিকাংশ ঘরের কাজ শুরু করলেও একটি ঘরের কাজও সম্পূর্ন করতে পারেনি। এদিকে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য এসব মডেল ঘর পেতে সালথা উপজেলা কৃষি অফিসে আবেদন করেছেন ৭০ জন কৃষক। কৃষি অফিস যাচাই-বাছাই করে ৩০ জন কৃষকের নাম প্রকল্প পরিচালকের নিকট পাঠায়। কিন্তু এই তালিকা থেকে কাউকেই ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। অভিযোগ আছে, বিশেষ সুবিধা নিয়ে এপিএস এর ঘর দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সালথা উপজেলার যদুনন্দি ইউনিয়নের কাজীপাড়ার মো. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমি এই বছর ৬-৭শ মণ পেঁয়াজ পেয়েছি। পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণের দেশীয় মডেল ঘরের আশায় আমি বিকল্প ব্যবস্থা করিনি। ঘরের ঠিকাদারের চাহিদামত টাকা না দেওয়ায় আমার ঘরের কাজ এখনও শুরু করা হয়নি। তাই আমি বাধ্য হয়ে কম দামে পেঁয়াজগুলো বিক্রি করে দিয়েছি। এতে আমার কয়েক লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
স্থানীয় গট্টি ইউনিয়নের কানইড় গ্রামের এক কৃষক বলেন, আমি ১০ হাজার টাকা খুশি হয়ে শাহজাহান স্যারকে দিয়েছি। অন্যরা ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়ে ঘর পেয়েছে।
রামকান্তুপুর ইউনিয়নের নারানদিয়া গ্রামের শাহিদ মিয়া বলেন, টাকা ছাড়া কি ঘর পাওয়া যায়? ঘর পেতে ৫০ হাজার টাকা লাগে।
বল্লভদী ইউনিয়নের পশ্চিম পিশনাইল গ্রামের নান্নু মোল্যা বলেন, ঘরের সকল খরচ সরকার বহন করার কথা থাকলেও মিস্ত্রি খাবারের খরচ আমাদের বহন করতে হয়েছে। এছাড়া আমরা ঘরের ফ্লোরে বালু না দেওয়া পর্যন্ত ঠিকাদারের লোক কাজে আসবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে।
এ বিষয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স জাকির এন্ড ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী মো. জাকির হোসেন বলেন, আমরা কোন অতিরিক্ত টাকা পয়সা নিচ্ছি না। কৃষকরা মিস্ত্রিদের স্বেচ্ছায় খাওয়াচ্ছে। আর যেসব ঘরে বেশি বালু লাগছে সেগুলোতে কৃষকরা বালু ফেলে দিচ্ছে।
টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাঠ কর্মকর্তা শাহজাহান আলী বলেন, সালথায় সরকারি ঘর বরাদ্দের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকায় আমরা সবাইকে ঘর দিতে দিতে পারি নাই। তাই আমার নামে উল্টাপাল্টা কথা বলছে।
সালথা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুদর্শন কর্মকার বলেন, মডেল ঘর পাওয়ার জন্য সালথা উপজেলা কৃষি অফিসে ৭০ জন কৃষক আবেদন করেন। কৃষি অফিস যাচাই-বাছাই করে ৩০ জন কৃষকের নাম প্রকল্প পরিচালকের কাছে পাঠানো হয় কিন্তু এই তালিকা থেকে কাউকেই ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এছাড়া কারা এসকল ঘর পেয়েছে সে বিষয়েও আমাদেরকে অবগত করা হয়নি।
সালথা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান বালী বলেন, ঘর বিতরণ, নির্মাণ ও টাকা নেওয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে আমরা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব।
ফরিদপুর জেলার সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা মো. শাহদাত হোসেন এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের সাথে কথা বলার জন্য অনুরাধ করেন।
আধুনিক পদ্ধতিতে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হেলাল উদ্দিন বলেন, এই মডেল ঘরগুলো পাওয়ার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। গণবিজ্ঞপ্তির প্রকাশ হওয়ার পরে কৃষকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা যাচাই-বাছাই করে ঘরগুলো কৃষকদের সুবিধার্থে বিনামূল্যে দিয়েছে। টাকা-পয়সা নিয়ে ঘর দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। টাকা পয়সা নিয়ে ঘর দেওয়ার ব্যাপারে আমরা অবগত নই। আর আমাদের ডিজাইনের বাহিরে ঘর করা বা বাড়তি টাকা নিয়ে ঠিকাদার ঘর করে দিবে এই ধরনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। টাকা পয়সা লেনদেনের বিষয়ে যদি কোনো কৃষক আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয় তাহলে আমরা তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী এই ঘরের কাজ ৩০ মার্চ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন কারণে ঠিকাদার ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন। ৩০ এপ্রিলের ভেতরে এই ঘরের কাজ সম্পন্ন করতে হবে। আমাদের জানামতে ৭০ শতাংশ ঘরের কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে।
তবে প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হেলাল উদ্দিন বলেছেন এই মডেল ঘরগুলো পাওয়ার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। সরেজমিনে গন বিজ্ঞপ্তির কোন খবর পাওয়া যায়নি এবং এর কোন সত্যতা মেলেনী।