ফরিদপুরে লংকারচর বালুমহাল ইজারা নিয়ে লংকাকান্ড:
যুবলীগ নেতাকে ইজারা পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ কৃষকদলের কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে
* দরপত্র ক্রয় করেন ১৯ জন, জমা পড়ে মাত্র ১টি
* দরপত্র জমা দিলে দেয়া হয় হুমকি
ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ঘোষপুর ইউনিয়নের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত গড়াই নদীর লংকারচর বালু মহালের ইজারা নিয়ে লংকাকান্ডের মতো ঘটনা ঘটেছে। বিএনপি পন্থী ঠিকাদারদের ক্রয়কৃত দরপত্র জমা দিতে বাঁধা সৃষ্টি করে যুবলীগ নেতাকে ইজারা পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে স্বয়ং দলটির সাবেক সংসদ সদস্যের ও কৃষকদলের কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে। এতে বিক্রিত ১৯টি দরপত্রের মধ্যে জমা পড়ে মাত্র একটি দরপত্র।
বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেছেন মেসার্স মোহনা ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী শেখ আজিজুল হক নামে এক ঠিকাদার। এতে ১০ জন ঠিকাদারের স্বাক্ষর রয়েছে। তবে কোনো অভিযোগ পাননি বলে জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন।
জানা যায়, গত ৬ ফেব্রুয়ারি জেলার বোয়ালমারী উপজেলার গড়াই নদীর লংকারচর বালু মহাল সহ তিনটি মধুখালী ও আলফাডাঙ্গার তিনটি বালু মহালের দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন জেলা প্রশাসন। এতে লংকারচর বালু মহালের সরকারি মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১ কোটি ২০ লাখ ৭৩ হাজার ৪১৮ টাকা। এই বালু মহালের আয়তন রয়েছে ৭৪ হাজার ১৪৭ একর।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী প্রথম ধাপে দরপত্র বিক্রয়ে শেষ দিন ছিল গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এবং ২৬ ফেব্রুয়ারি দরপত্র জমা দেয়ার শেষ দিন ছিল। এরমধ্যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দরপত্র ক্রয় করেন ১৯ টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত মাত্র ১টি দরপত্র জমা হয়। দরপত্রটি জমা দেন বোয়ালমারী উপজেলার ময়না ইউনিয়নের কান্দাকুল গ্রামের বাসিন্দা ও মেসার্স রবিউল ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী রবিউল ইসলাম। পরবর্তীতে জেলা বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্তে নিয়মানুযায়ী এবং সরকার নির্ধারিত মূল্য থেকে প্রায় ৩৬ লাখ টাকা বেশি হওয়ায় ইজারাটি তাকে দেয়া হয় বলে জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান মোল্যা জানিয়েছেন।
এদিকে দরপত্র জমা দেয়ার ক্ষেত্রে হুমকি-ধমকি সহ বাঁধা দেয়ার অভিযোগ করেছেন বঞ্চিত ঠিকাদাররা। তাদের অভিযোগ, ফরিদপুর-১ আসনের (মধুখালী, আলফাডাঙ্গা ও বোয়ালমারী) সাবেক সংসদ সদস্য এবং কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি খন্দকার নাসিরুল ইসলাম হুমকি-ধমকি দেন এবং ভয়ভীতি দেখান। যে কারনে অন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেননি। তিনি যুবলীগ নেতা রবিউল ইসলামকে ইজারাটি পাইয়ে দেয়ার বন্দোবস্ত করেন।
জানা যায়, রবিউল ইসলাম ফরিদপুর-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরীর ঘনিষ্টজন। এছাড়া বোয়ালমারী উপজেলা যুবলীগের সদস্য এবং ময়না ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি পদে রয়েছেন।
বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করেন মেসার্স মোহনা ট্রেডার্সের স্বত্ত্বাধিকারী শেখ আজিজুল হক। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আফজাল হোসেন খান পলাশ ও জুলফিকার হোসেন জুয়েল সহ কয়েকজন বিএনপি নেতার উপস্থিতিতে জেলা প্রশাসকের হাতে অভিযোগপত্রটি তুলে দেয়া হয়।
অভিযোগে উল্লেখ করেন, রবিউলের সাথে বিএনপির উর্ধ্বতন নেতা জড়িত হয়ে আমাদেরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে দরপত্র জমা না দেয়ার জন্য বলা হয়। আমরা এহেন অবস্থায় আপনার কাছে দরপত্র জমা দিতে ব্যর্থ হই এবং বিভিন্নভাবে তাঁদের গুন্ডা বাহিনী দিয়ে দরপত্র ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং বিষয়টি যেন কারও কাছে প্রকাশ না করি সে জন্য প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়।
এছাড়া আজিজুল হক বলেন, খন্দকার নাসিরুলের সাথে আমাদের শর্ত ছিল আওয়ামী লীগের কোনো লোক ইজারা নিতে পারবে না। বিষয়টি নিয়ে নাসিরুল ভাইয়ের কাছের লোক রিপনকে দেয়ার জন্য চুক্তি হয়। কিন্তু তাকে না দিয়ে বেশি টাকার বিনিময়ে ওই যুবলীগ নেতাকে দেয়া হয়। আমরা যারা দরপত্র ক্রয় করেছিলাম প্রত্যেককে হুমকি দেয়া হয়। এমনকি মৃত্যঞ্জয় নামক একজনকে তুলে নিয়ে যায় তাঁর লোকজন। পরে তাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়।
তিনি আরও বলেন, গতবার সাবেক এমপি নিক্সন চৌধুরী ওই যুবলীগ নেতাকে বালু মহালটি পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এবার নাসির ভাইয়ের মাধ্যমে যদি বালু মহাল নেয় তাহলে আমাদের থাকার চেয়ে না থাকাই ভাল।
ইজারার পাওয়ার বিষয়ে কথা বলতে মুঠোফোনে যোগাযোগ হয় এই রবিউলের সাথে। তিনি দাম্ভিকতার সুরে বলেন, ‘এই বালু মহাল আমার। বিগত দিনের মালিক আমি, বর্তমান মালিক আমি এবং ভবিষ্যতের মালিকও আমি। আমি সরকারের রাজস্ব বিভাগে ৫০ লাখ টাকা বেশি দিয়েছি। তাহলে আমাকে দিবে না, কাকে দিবে।’
এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন কৃষকদল নেতা খন্দকার নাসিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমিতো কোনো বালুর ব্যবসা করি না। আমি কেন বাঁধা দিতে যাব। আমি বাঁধা দিয়েছি কোনো প্রমাণ দিতে পারবে। যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে তারা মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনএমের লোক। ষড়যন্ত্র করে শিডিউল কিনে আমাকে হয়রানি করতেছে।
এদিকে জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান মোল্যা জানান, বিষয়টি নিয়ে কোনো অভিযোগ পাননি। জেলা প্রশাসক বলেন, আমার কাছে অভিযোগ আসেনি এবং অভিযোগ আমলে নেয়ার কিছু নেই। শিডিউল কিনে কেউ যদি ডিসি, ইউএনও অফিসে না দিতে পারে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের জানাবে কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে জানায়নি। তারা যদি আমার দপ্তরে এসে বাঁধার সৃষ্টি হয়ে আমাকে জানাতো তাহলে আমি দেখতাম কোন সেই পাওয়ারফুল লোক, কে সেই মাস্তান। বাইরে থেকে কেউ যদি বাঁধা সৃষ্টি করে সে বিষয়তো আমার মাথা ব্যাথার না। জমা দেয়ার পরে কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্থ হয় বা অন্যায় অবিচারের শিকার হয় তাহলে আমার দেখার বিষয়।
তিনি আরও বলেন, বালু মহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় সিদ্ধান্তে নীতিমালা অনুযায়ী ইজারা দেয়া হয়েছে। নিয়ম রয়েছে, সরকারি মূল্যের চেয়ে যদি বেশি হয় এবং একক কেউ থাকে তাহলে তাকে দেয়া যায়। আমরা সরকারি মূল্যের চেয়ে প্রায় ৩৬ লাখ টাকা বেশি পেয়ে ইজারা দিয়েছি। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি, স্বচ্ছতার সাথে টেন্ডার হয়েছে।